HSC Bangla বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বিভীষণের
প্রতি মেঘনাদ
মাইকেল
মধুসূদন দত্ত
নিকষার তিন ছেলে – (রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ)
আর রাবণের ছেলে মেঘনাদ
সুমিÎv - `yB †Q‡j – ivg Ges jÿY
মেঘনাদ-অরিন্দম,ধীমান্, বাসবত্রাস, বাসববিজয়ী,
রাবণআন্তোজ, বীরেন্দ্রবলি, রাবণিদাস, পরাক্রমদাস, ইন্দ্রজিৎ
বিভীষণ- রক্ষোরথি, রক্ষোবর, বিধাতা, প্রভু,ধর্মপদগামী,
রক্ষোমনী, তাত, রাঘবদাস,রাবনঅনুজ,রাক্ষসরাজানুজ
লক্ষণ- কীট, তস্কর, চন্ডাল, বনবাসী, দম্ভী,
দুরাচর, দৈত্য, নরাধম, রামানুজ,সৌমিত্র,
রাবণ- রক্ষ:শ্রেষ্ঠ
রাম- অধম, রাঘব
কুম্ভকর্ণ-শূলিশম্ভুনিভ
“এতক্ষণে”- অরিন্দম কহিলা বিষাদে“
জানিনু কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল (প্রবেশ করল)
রক্ষঃপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব
এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ? শূলিশম্ভুনিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী!
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে রুদ্ধদ্বার নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশ করল লক্ষণ। তার এই অনুপ্রবেশের অন্যতম সহায়ক রাবণের কনিষ্ঠ সহোদর বিভীষণ। এটি বুঝতে পেরে মেঘনাদ বিস্মিত ও মর্মাহত হয়। বিভীষণের এরূপ কাজ করা কি উচিত হয়েছে? সতী নিকষা যার মা, তার পক্ষে এ রকম একটি হীন কাজ করা কী করে সম্ভব? তাছাড়া যেখানে রয়েছে রাবণের মধ্যম সহোদর কুম্ভকর্ণ, যে কিনা শূলপাণি মহাদেবের মতো; আর যেখানে তার ভাইয়ের পুত্র দেবতাদের রাজা ইন্দ্রকে জয় করেছে, সেখানে বিভীষণ কীভাবে এমন কাজ করল? মেঘনাদের মনে প্রশ্ন জাগল— এতকিছুর পরও শত্রুকে পথ চিনিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে এলো? চোরকে প্রশ্রয় দিল? চণ্ডালের মতো নিম্নশ্রেণির কাউকে এনে রাজকক্ষে স্থান দিল?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরু জন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।”
কিন্তু তাকে সে অবহেলা করে না। কারণ। পিতৃতুল্য গুরুজনের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা আছে। মেঘনাদ অস্ত্রাগারে গিয়ে যুদ্ধের সাজ গ্রহণ করে আসবে বলে বিভীষণকে দ্বার থেকে সরে দাড়াতে অনুরোধ করল । কারণ সে রামানুজ লক্ষণকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে চায়। তার সাথে যুদ্ধ করে, তাকে পরাজিত করে লঙ্কার সমস্ত কলঙ্ক কালিমা মুছে দিতে চায় ।
উত্তরিলা বিভীষণ, “বৃথা এ সাধনা,
ধীমান্! রাঘবদাস আমি; কী প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে
অনুরোধ?” উত্তরিলা কাতরে রাবণি;“
হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে!
মেঘনাদের এসব কথা এবং অনুরোধ শুনে বিভীষণ জবাব দিল- না, তা হয় না। তোমার এ চেষ্টা বৃথা। কারণ তোমার অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে আমি কি তার (রামের) বিরুদ্ধে কাজ করব? তখন রাবণের পুত্র রাবণি (মেঘনাদ) কাতর সুরে বলল, হে শ্রদ্ধেয় পিতৃব্য, তোমার এ কথা শুনে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
রাঘবের দাস তুমি?
কেমনে ও মুখে
আনিলে এ কথা, তাত, কহ
তা দাসেরে!
স্থাপিলা বিধুরে বিধি
স্থাণুর ললাটে;
পড়ি কি ভূতলে শশী
যান গড়াগড়ি
ধূলায় ? হে
রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে
কে তুমি? জনম তব কোন
মহাকুলে?
তুমি রাঘবের দাস? এ কথা তুমি মুখে আনলে কী করে? পিতৃব্য, সে কথা তোমার এ দাসকে বলো। বিধাতা চালকে আকাশে যে নিশ্চল করে স্থাপন করেছেন, তাই বলে চাদ কি ধুলায় গড়াগড়ি যায়? তাহলে তুমি কী করে এমন করলে? তুমি রক্ষকুলের বীর হয়ে কী করে নিজের পরিচয় ভুলে গেলে? তুমি কি ভাবতে পার না কোন মহাকুলে তোমার জন্ম; তোমার উচ্চ বংশপরিচয়?
কে বা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে
করে কেলি রাজহংস পঙ্কজ-কাননে
যায় কি সে কভু, প্রভু, পঙ্কিল সলিলে,
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র কেশরী,
কবে, হে বীরকেশরী, সন্তাষে শৃগালে
মিত্রভাবে? অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞম তুমি,
অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে।
আর কে সে অধম রাম, তা কি তুমি জান না? রাজহাঁস কি কখনো কাদা, ময়লা, ঘোলা জলে যায়, সাঁতার কাটে? সে তো স্বচ্ছজলে সরোবরে জলকেলি করে বেড়ায়। সে তো বন্ধ জলাশয়ে শেওলার মধ্যে ঘোরাঘুরি করে না। পশুরাজ সিংহকে কি কখনো দেখেছ শিয়ালের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে, কিংবা সম্মানে তার কাছে মাথা নত করতে? সিংহরাজের কেশর তার আভিজাত্যের সন্মানের রাজার চিহ্ন বহন করে, শিয়ালের তা নেই, সে সিংহের দাস। আমি জ্ঞানহীন মূখ, তোমার আজ্ঞাবহ, কিন্তু তুমি তো 'সর্বজ্ঞানে মহাজ্ঞানী, গুণী। তবে কেন এমন করলে? তোমার তো কিছুই অজানা নয়।
ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষ্মণ; নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে?
কহ, মহারথী, এ কি মহারথীপ্রথা?
নাহি শিশু লপুরে, শুনি না হাসিবে
এ কথা! ছাড়হ পথ; আসিব ফিরিয়া
এখনি দেখিব আজি, কোন দেলে,
বিমুখে সময়ে মোরে সৌমিত্রি কুমতি!
দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ,
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের! কী দেখি
ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে?
লক্ষণ তো ছোট মনের হীন মানসিকতাসম্পন্ন এক নরাধম। তা না হলে অস্ত্রহীন, যুদ্ধের বেশহীন অপ্রস্তুত আমাকে তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে বলে? হে মহাবীর, তুমিই বলো- নিরস্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করা কি কোনো বীরের আচরণ-প্রথা? একজন শিশুও খুঁজে পাবে না এ লঙ্কাপুরীতে, যে এরূপ কথা শুনে হাসবে না। কাজেই আমার কথা শোনো, পথ ছেড়ে দাও, আমাকে যেতে দাও, আমি এখনই ফিরে আসব। তখন সুমিত্রার সন্তান লক্ষণকে তার কুমোহ মিটিয়ে দেব। রক্ষকুলের হে বীর, দেবদৈত্যদের সঙ্গে আমার যুদ্ধ তো তুমি স্বচক্ষে দেখেছ । সেখানকার পরাক্রমও তুমি জাননা। তাহলে দুর্বল মানবকে। দেখে ভয়ে কি পালাবে তোমার এ আজ্ঞাবহ?
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রগল্ভে পশিল
দম্ভী; 'আজ্ঞা কর দাসে, শাস্তি নরাধমে ।
তব জপুরে, তাত, পদার্পণ করে
বনবাসী! হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে
এমে দুরাচার দৈত্য? প্রফুল্ল কমলে
কীটস? কহ তাত, সহিব কেমনে
হেন অপমান আমি, ভ্রাতৃ-পুত্র তব?
লঙ্কাপুরীর তীর্থস্থান এই নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে নির্ভীকচিত্তে। যে অহংকার সে করছে, তুমি এই আজ্ঞাবহ দাসকে অনুমতি করো সেই নরাধমকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে। তোমার এই অন্তঃপুরে জন্ম নিয়ে আজ এমন নির্বাসন দণ্ড, বনবাস! হে প্রভু, এই শ্রীমণ্ডিত অতি মনোরম সুসজ্জিত বাগানে ভুল করে কেন এই দুরাচার দানবকে নিয়ে এলে? এ কি অপূর্ব। সুন্দর বিকশিত ফুলের মধ্যে কীটের মতো নয়? বলো, কী করে আমি তা মেনে নেব? তোমারই ভাইয়ের পুত্র হয়ে কী করে সহ্য করব আমি এই অপমান?
তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে?"
মহামন্ত্রবলে যথা শিরঃ ফণী,
মলিনবন লাজে, উত্তরিলা রথী।
রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আহাজে
“নহি দোষী আমি, বস; বৃথা ভস মোরে
তুমি! নিজ কর্মদোষে, হায়, মজাইলা
এ কনক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি?
আর রক্ষোকুলের ধীর হয়ে তুমি কীভাবে তা সহ্য করছ? মহামন্ত-বলে ফণা তোলা সাপ যেমন মাথা নত করে, তুমিও তাহলে তেমনি করে মাথানত করেছ? মেঘনাদের
এসব কথা শুনে রক্ষকল বীৱ বৰ্থী বিষণ তখন মেঘনাদকে বলল– এসবের জন্য আমি দায়ী নই। আমাকে অহখাই দোষারোপ কর; বৃথাই তিরস্কার করা যায়। রাজার কম-দোষেই ক্ষা আজ এমন বিপদগ্রস্ত। এ অবস্থার জন্য রাজা নিজেও বিপগ্রস্ত ।
বিরত সতত পাপে দেবকুল; এবে
পাপপূর্ণ লঙ্কাপুরী; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কালসলিলে!
নাঘবে পলাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী
তেই আমি। পরদোষে কে চাহে মজিতে?"
মনে রেখো, দেবতারা সবসময় পাপমুক্ত। লঙ্কাপুরী এখন পাপে পূর্ণ। ঝড়ঝঞায় পৃথিবীর মতো ডুবতে বসেছে লঙ্কাপুরী, ভয়াল স্রোতে সব তছনছ হয়ে যাচ্ছে, ধ্বংসের মুখে আজ লঙ্কা নগরী। রঘুবংশীয় রামচন্দ্রের পদতলে যেহেতু আমি আশ্রয় লাভ করেছি সেহেতু আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি না। আর অন্যের দোষ মাথায় নিয়ে কে বিপদগ্রস্ত হতে চায়?
রুষিলা বাসবাস । গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি,
কহিলা বীরেন্দ্র বলী,-“ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানু , বিখ্যাত জগতে
তুমি; - কোন্ ধর্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি,-এ সকলে দিলা
জলাঞ্জল ?
বাসবের ভয়ের কারণ যে মেঘনাদ তা শুনে সে ক্ষুব্ধ হলো সেই ক্ষোভ গভীর রাতে স্তব্ধ পরিবেশ ভেঙে আকাশে মেঘের গর্জনের মতো। বীর তখন আক্রোশে ধর্মপথানুসার রাক্ষসরাজানুজকে বলল, তুমি জগতে বিখ্যাত, কোন ধর্মানুসারে তুমি এমন কথা বলছ, এই আজ্ঞাবহ দাসকে একবার শোনাও। আত্মীয়ের পরিচয়, সহোদরের বন্ধন, জাত-ধর্ম এসব কী করে জলাঞ্জলি দিলে?
শাস্ত্রে বলে, গুণবা যদি
পরজন, গুণহীন স্বজন, তথাপি
নিখুঁণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা!
এ শিক্ষা, হে রক্ষোবর, কোথায় শিখিলে?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমায় হেন সহবাসে,
হে পিতৃব্য, বর্বরতা কেন না শিখিৰে?
গতি যার নীচ (ইতর) সহ, নীচ সে দুর্মতি (অসৎ বা মন্দ
বুদ্ধি)।"
গুণহীন, মূর্খ হলেও আপনজন আপনজন-ই থাকে। আর পর গুণবান হলেও সে পর, সে কখনো আপন হয় না। তাই তো গুণবান পরজন থেকে গুণহীন স্বজন উত্তম। স্বজন ত্যাগ করার শিক্ষা তুমি কোথা থেকে লাভ করলে হে রক্ষকুলের বীর? অথচ দেখ, আমি অযথাই তোমাকে তিরস্কার করছি। তাদের সঙ্গে থাকার জন্য। হে মান্যবর বীর, পিতৃব্য, তাই যদি হয়, তবে কেন শিখবে না বর্বরতা? চিন্তা যার অসৎ, হীন যার মানসিকতা, সে তো নিকৃষ্ট পথেই ধাবিত হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক, আর সেটাই তো সত্যি।
অনেক ধন্যবাদ স্যার
ReplyDeleteDhonnobad
ReplyDelete